এস এম গোলাম রাবিব
নেত্রকোনা প্রতিনিধি :

এমন একটা সময় ছিল যখন নেত্রকোনার সকলের ঘরে গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ ও রাখালের আনাগোনা- এটিই ছিল নেত্রকোনার গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। কিন্তু এখন প্রবাদ বাক্যে পরিণত হতে চলেছে। আধুনিকতায় আজ সেই সব ঐতিহ্য বলাচলে অতীত। এখন আর দেখা যায় না রাখাল গরুর পাল নিয়ে মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে মাঠের দিকে। বিশাল বিশাল মাঠে দেখা যায় না গরু ছাগল অবাধ বিচারণ। গৃহকর্তাকে আর খেপলা জাল নিয়ে পুকুরে মাছ ধরতেও দেখা যায়না।

আর গ্রামবাংলা সমৃদ্ধির প্রতীক ধানের গোলা এখন বিলুপ্ত প্রায়। কালের বিবর্তনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার প্রসারের ফরে বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিক্ষেত ও কৃষকের ঐতিহ্যবাহী গোলা শিল্প। মাঠের পর মাঠ ধান ক্ষেত থাকলেও অধিক কৃষকের বাড়িতে নেই ধান মজুদ করে রাখার বাঁশ বেত ও কাতা দিয়ে তৈরি গোলাঘর। এসব স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে অনেক বয়োবৃদ্ধ হঠাৎ থমকে যান, ফিরে যান তার শৈশব আর কৈশরে।
নেত্রকোনার সবকটি উপজেলার গ্রামেই দেখা গেছে মাটির ঘর, বাড়িতে বাড়িতে পালন করা গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগী। প্রতিটি বাড়িতে শোভা পেত ধানের গোলা আর ছোট বড় অসংখ্য পুকুর। এসব পুকুরে কখনও বানিজ্যক ভাবে মাছ চাষ করা হয়নি। পুকুর মালিক তার পুকুরে যে মাছ চাষ করেছেন তা নিজের পরিবারসহ প্রতিবেশি ও আত্মীয় স¦জনের বাড়িতে দিয়েছেন। আশির দশকেও উপজেলার অধিকাংশ গ্রামে এসব কিছু দেখা গেলেও বর্তমানে তা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। গ্রামের কিছুটা বৃত্তবান শ্রেনীর মানুষের বাড়িতে থাকত রাখাল। সে ওই বাড়ির সকল কাজ করত। এখন আর কোন বাড়িতে দেখা যায় না রাখালকে। গৃহকর্তা জাল নিয়ে বাড়ির পাশে পুকুরের বুক সমান পানিতে নেমে মাছ ধরতেও দেখা যায়না, এমনকি গৃহীনি তার বাড়ির একমাত্র মাটির ঘরকে কাঁদা মাটি দিয়ে নেপে চকচকে করতেও আর দেখা যায় না।

জেলা সদরের মেদনী গ্রামের শাহাজাহান আলী জানান, গোলায় ধান রাখা কৃষকের জন্য খুবই ভালো। কিন্তু এগুলো আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। গোলাগুলো আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য বহণ করে। আমার দাদার আমল থেকে দেখে এসেছি এগুলো। ধান রাখার পাশাপাশি ঐতিহ্য রক্ষায় তাই এখনো রেখে দিয়েছি।

জেলা সদরের রাজুর বাজারের খালেক মন্ডল (৯৫) তিনি বলেন, শৈশব আর কৈশরের কথা মনে উঠলে বড্ড খারাপ লাগে। কি ছিল আর এখন কি হয়েছে। বছরে দুই বার আমরা মাঠে ধানের আবাদ করেছি। বাকি সময়ে মাঠের পর মাঠ খালি পড়ে থাকত। সে সময়ে ছিল না কোন প্রতিবন্ধকতা, ছিল না হানাহানি সকলের ভিতরে ছিল অন্য রকমের এক আনন্দ। পুকুর,খাল বিল, নদ নদীতে ছিল মাছের সমারোহ, এখন সব কিছুই যেন স্মৃতি।
প্রবীন কৃষক মিজান, বাচ্চু, ইচরাইলসহ বেশ কয়েক জনের সাথে কথা বললে তারা বলেন, ২০ বছর আগে আমরা গরু দিয়ে হালচাষ করতাম। হাল চাষ করেই আমরা সংসার চালাতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর প্রচলন হওয়ায় গরু দিয়ে হাল চাষের প্রচলন আর নেই বললেই চলে। কিন্তু একসময় এই গরুর হাল ছিল একমাত্র মাধ্যাম। এভাবেই নানা কারণে বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য গরুর হালচাষ ও রাখাল।

জেলার রৌহা গ্রামের কৃষক ওহেদুল বিশ্বাস সাথে কথপোকথনে বোঝা গেল এখন গোলা ঘরের কদর নেই। তিনি জানান যে ধান পাই, তা তো বিক্রি করে আর খেতেই ফুরিয়ে যায়। গোলায় রাখবো কি ? তবুও অযত্ন- অবহেলায় বাড়িতে রেখে দিয়েছি। একদিন এভাবেই শেষ হয়ে যাবে।

জেলার প্রবীণেরা বলছেন, প্রবাদের সেই গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ এখনো আছে। দেশের প্রতিটি কৃষক পরিবারে রয়েছে কমপক্ষে একটা, দুটি গরু, পুকুরও আছে অনেকের। শুধু কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে গ্রামীণ ঐতিহ্য ধানের গোলা ও রাখাল।
বৃদ্ধ কৃষক আলী হোসেন জানালেন আগে আমরা গোলাতেই ধান রাখতাম। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গোলা থাকতো। তবে এখন আর নেই। নাতিদের কাছে বললে তারা বিশ্বাসও করতে চায় না।
এভাবেই বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার সব ধরনে প্রাচীন ঐতিহ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *