আনোয়ার হোসেন আকাশ,
রাণীশংকৈল (ঠাকুরগাঁও)প্রতিনিধি:

মনতাজ বেগমের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার গোয়ালদিঘী গ্রামে। স্বামী জাকির হোসেন। মাছ ব্যবসায়ী। মনতাজ-জাকির দম্পতি অবস্থাসম্পন্ন। নিজেদের বাড়ি-জমি সবই আছে। ভূমিহীন বা গৃহহীন বলতে যা বুঝায় তার মধ্যে তিনি কোনভাবেই পড়েন না। কিন্তু মুজিব জন্মশত বর্ষ উপলক্ষে সরকারের দেওয়া পাকা ঘর পেতে তিনি ভূমিহীন এবং গৃহহীন হয়েছেন। নিজের পাঁচ ছেলের জন্য ছয়টি ঘরে পেতে সাত লাখ টাকা দিয়েছেন ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে। ঘরও পেয়েছেন।

শুধু তিনি নয়, হরিপুরে আশ্রয়ন প্রকল্পে মনতাজ বেগমের মতই আরও অন্তত ২০ জন অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তি যাদের বাড়ি, জমি আছে তাদেরকে টাকার বিনিময়ে ঘর পাইয়ে দিয়েছেন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান।অন্যদিকে যারা একেবারেই হতদরিদ্র, জমিজমা ও ঘরবাড়ি নেই প্রকৃত ভূমিহীন তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েও ঘর পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেননি ইউপির চেয়ারম্যান।

উপজেলার বকুয়া ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আবু তাহেরের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে মুজিব জন্মশতবর্ষর ঘর বরাদ্দ নিয়ে এমন গুরুতর অভিযোগ উঠলেও তিনি সেটি অস্বীকার করেছেন।

তবে চেয়ারম্যান যে ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে অবস্থাসম্পন্নদের ঘর পাইয়ে দিয়েছেন, আবার ভূমিহীনদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঘর দেননি, এরকম ভূক্তভোগীর সঙ্গে চেয়ারম্যান তাহেরের কথোপকথনের অডিও রেকর্ড ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়েছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় দরিদ্র, ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মধ্যে ঘর বিতরণ করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে হরিপুর উপজেলার ভূমিহীনদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া সরকারের ৩২টি ঘরের মধ্যে ২৬টি ঘরেই তালা ঝুলছে।

ঘর যারা বরাদ্দ পেয়েছেন তারা কেউই ঘরগুলোতে থাকেন না। কারণ যাদের ঘর দেওয়া হয়েছে তারা সকলেই বিত্তবান। নিজস্ব জায়গায় জমি, বাড়ি আছে। এমনকি তাদের কারো কারো মোটরসাইকেল আছে। কারো বা জমি চাষাবাদের ট্রাক্টর আছে। আর যারা প্রকৃত দরিদ্র, ভূমিহীন তাদের কেউই ঘর বরাদ্দ পাননি।

সরজমিনে দেখা গেছে, হরিপুর উপজেলার ৩ নং বকুয়া ইউনিয়নে গোয়ালদিঘী গ্রামে ভূমিহীনদের জন্য মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রথম ধাপে গত মে মাসে ২৬টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই ২৬টি ঘরই টাকার বিনিময়ে স্বচ্ছল ও বিত্তবান ব্যক্তিদেরকে দেওয়া গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ঘর বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ উঠার পর দ্বিতীয় ধাপে ছয়টি ঘর বরাদ্দ স্থগিত করা হয়।

অন্যদিকে প্রকৃত ভূমিহীনদের কাছ থেকে টাকা নিয়েও ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভূমিহীন যারা ঘর পাওয়ার আশায় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে টাকা দিয়েছিলেন তারা ঘর না পেয়ে প্রতিদিন চেয়ারম্যানের বাড়ি, ভুমি অফিস ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে ধর্ণা দিচ্ছেন।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবস্থাসম্পন্ন বিত্তবান যাদেরকে টাকার বিনিময়ে ঘর দেওয়া হয়েছে বা যারা ঘর পেয়েছেন তারা হলেন- গোয়ালদিঘী গ্রামের আনোয়ার, ইসমাইল(১), মন্টু, আলতাফ, আব্বাস উদ্দীন, আমির উদ্দিন, মহিরুল, মিজান, মনতাজ, বজির, মাসিদুল, জালাল, বাকির উদ্দীন, কুশিম উদ্দীন, সাঈদ আলী, শাহাজান, আজাদ, নুরুল, আসমা খাতুন। এদের সবাই বিত্তবান ও চাষাবাদের জমি আছে। নিজের জায়গায় পাকা বাড়ি আছে। কারো কারো মোটরসাইকেল ও ট্রাক্টর আছে।

অবস্থাসম্পন্নরা কিভাবে ঘর পেয়েছেন জানতে চাইলে তাদের প্রায় প্রত্যেকেই বলেন, প্রতিটি ঘরের জন্য চেয়ারম্যানকে ৯০ হাজার থেকে এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন। তারা কেউই বিনা পয়সায় ঘর নেননি।

মনতাজ বেগম বলেন, ‘আমার পাঁচটা ছেলে সন্তান। ছয়’টা ঘরের জন্য চেয়ারম্যানকে সাত লাখ টাকা দিয়েছি। তার পর ঘর পেয়েছি ‘

অপরদিকে যারা প্রকৃত ভূমিহীন তাদের কেউই আবেদন করে ঘর পাননি। আবার আবেদনের পাশাপাশি কয়েকজন ঘর পাওয়ার আশায় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে টাকাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তারাও ঘর পাননি। এমন ভূক্তভোগীদের মধ্যে আছেন গোয়ালদিঘী গ্রামের প্রকৃত ভুমিহীন ইসলাম, দুরুল, রুবেল, খালেদ, সাদ্দাম। তারা আবেদন করলেও তাদের ভাগ্যে মুজিব শতবর্ষর ঘর পাননি।

ভূমিহীনদের মধ্যে ঘর পাওয়ার জন্য নিজের শেষ সম্বল গরু ও ছাগল বিক্রি করে এবং ধার দেনা করে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে টাকা দিয়েছিলেন, মানিক হোসেন, ইসমাইল হক, এরফান আলী, সবুরা বেগম। কিন্তু তাদের কেউই ঘর পাননি। এখন তারা চেয়ারম্যানের কাছে টাকা ফেরত চেয়ে ধর্ণা দিচ্ছেন। কিন্তু টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না।

আনোয়ার, মানিক সহ আরো অনেকেই অভিযোগ করে জানান, ‘মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দেওয়ার কথা বলে চেয়ারম্যান আবু তাহের ও তার লোক আমাদের কাছে প্রতি ঘরের জন্য ৭০ হাজার টাকা থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত নেন। কিন্তু আজও আমরা ঘর বুঝে পেলাম না। আমরা ঋণ করে, হালের গরু ও ছাগল বিক্রি করে টাকা দিয়েছি। এখন আমরা নিঃস্ব। আমাদের হয় ঘর দেন না হলে আমাদের টাকা ফেরত দেন’।

অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু তাহের। তিনি বলেন, ‘যা হয়েছে হরিপুর উপজেলার আগের ইউএনও মহোদয় আর ভূমি কর্মকর্তা (এসিলেন্ট) জানেন। তিনাদের মাধ্যমে সব হয়েছে।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।

হরিপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাকিবুজ্জামান বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান আবু তাহেরের বিরুদ্ধে অনেক আগ থেকেই ঘর দেওয়ার কথা বলে অর্থ লেনদেনের কথা শুনেছি। বিষয়টি একাধিকবার উপজেলা মিটিংয়ে উপস্থাপন করা হলেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানান এই কর্মকর্তা।

ঘর বরাদ্দে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে হরিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বহ্নি শিখা আশা কথা বলতে রাজী হননি।

এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মো. মাহাবুবর রহমান এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘ঘর বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ শুনেছি। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হবে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *