আনোয়ার হোসেন আকাশ,
রাণীশংকৈল (ঠাকুরগাঁও)প্রতিনিধি:

নিখোঁজের এক দিন পর ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের কাশীডাঙ্গা গ্রামের তীরনই নদী থেকে মা ও দুই সন্তানের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ হওয়ার পরেরদিন গত বুধবার সকাল আটটার দিকে নাসিমা (৩২) ও তাঁর দুই ছেলে শাওন (৭) সাফায়েত ওরফে সাফাতের (৪) লাশ পাওয়া যায়।

ময়নাতদন্তের পর রাতেই মৃত নাসিমার বাবার বাড়ি উপজেলার কলন্দা পশ্চিমপাড়ায় ও দুই সন্তান শাওন আর সাফায়েতকে তাদের দাদার বাড়ি কাশীডাঙ্গা গ্রামে দাফন করা হয়।

মরদেহ উদ্ধারের সময় মায়ের শাড়ির আচলে দুই ছেলের হাত বাঁধা ছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।

এদিকে মৃত নাসিমার মা খালেদা খাতুন এটিকে হত্যা দাবি করলেও নাসিমার শ্বশুর সামসুল হক ঘটনাটি আত্নহত্যা বলে দাবি করছেন। এ নিয়ে এখনও এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি রয়েছে। এটি হত্যা নাকি আত্নহত্যা !

খালেদা বেগমের দাবি, তার জামাই একজন জুয়াড়ু। জুয়ার টাকার জন্য আমার মেয়েকে প্রায় অত্যাচার করত। এ কারণে সংসারে অশান্তি লেগেই ছিল।

তবে স্থানীয়রা ধারণা করছে এটি একটি হত্যাকাণ্ড আবার অনেকে বলছেন, অভিমান করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন তারা।

নাসিমার বাবার বাড়ি রানীশংকৈল উপজেলার কলন্দা পশ্চিমপাড়ায় সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়,স্বামীর অলসতা আর পাশাপাশি জুয়ার আড্ডায় আসা-যাওয়া নিয়ে নাসিমা বেগমের দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না।

এই দুশ্চিন্তার মধ্যেই দুই ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন সাজিয়েছিলেন তিনি। স্বামীর স্বভাবের কথা ভেবে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সম্মতিতে নিজের গরুগুলো বাবার বাড়ি কলন্দা পশ্চিমপাড়া গ্রামে পাঠিয়ে দেন নাসিমা। হাতে টাকা না থাকায় সেই গরু ফিরিয়ে এনে বিক্রি করতে পীড়াপীড়ি শুরু করেন নাসিমার স্বামী আবদুর রহিম।

নাসিমা কিছুতেই গরুগুলো বিক্রি করতে চাইছিলেন না। কিন্তু রহিম কোনো প্রকার ছাড় দিতে নারাজ। এ নিয়ে নাসিমার সঙ্গে তাঁর ঝগড়াবিবাদও হয়। ঘটনার দিন শ্বশুরবাড়ি থেকে গরু আনতে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান রহিম। এই ক্ষোভেই দুই ছেলে নিয়ে ভরা নদীতে ঝাঁপ দেন তিনি। ঝাঁপ দেওয়ার আগে নিজের পরনের আঁচলে ছেলেদের হাত নিজের হাতে বেঁধে নেন। ঝাঁপ দেওয়ার পরই প্রবল স্রোতে তাঁরা মুহূর্তে তলিয়ে যান।

নাসিমার ভাবি খাদিজা বলেন, ‘নিজেই কোলেপিঠে করে নাসিমাকে বড় করেছি। কিছুতেই ভুলতে পারব না।’ বলতে বলতে কণ্ঠ ধরে আসে তাঁর। এরপর উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠেন।

এসময় নাসিমার ছোট বোন লাবণী বলেন, ‘ছেলে দুইটার মুখের দিকে চেয়ে আমার বোন বেঁচে ছিল। সেই সন্তানকে নিয়ে আত্মহত্যা করবে, বিশ্বাস করার মতো না।’

নাসিমার বড় ভাই ফারুক বলেন, ২০১৪ সালে নাসিমার সঙ্গে কাশীডাঙ্গা গ্রামের রহিমের বিয়ে হয়। তাঁদের সংসারে দুটি ছেলেসন্তান জন্ম নেয়। ব্যক্তিগত জীবনে রহিম একটু অলস প্রকৃতির। সেভাবে কাজকর্ম করতে চাইতেন না। পাশাপাশি এলাকার জুয়ার আড্ডায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল।

এ নিয়ে নাসিমা একবার ছেলেদের নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসে। শেষে ছেলেদের কথা ভেবেই আবার ফিরে যায়। যাওয়ার সময় সে বলে যায়, ছেলে দুইটা বড় হলেই তাঁর আর কিছু লাগবে না। বড় না হওয়া পর্যন্ত এভাবে আর এখানে আসবে না। ‘নাসিমা ঠিকই বাবার বাড়িতে আসলো, তবে জীবিত নয়, লাশ হয়ে। এটা আত্মহত্যা নয়, হত্যাকাণ্ড।’ তাঁর দাবি, শ্বশুরবাড়ির লোকজন নাসিমা ও তাঁর ছেলেদের হত্যা করে পরে নদের পানিতে ফেলে দেয়। তা না হলে রাতভর কয়েক শ মানুষ তল্লাশি করেও তাঁদের খুঁজে পাওয়া গেল না কেন ? এ ছাড়া লাশ উদ্ধারের পর কারও পেটে পানিও ছিল না।

নাসিমার বাড়ি কলন্দা পশ্চিম পাড়া থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে তার শ্বশুরবাড়ি। সেখানে গিয়ে নাসিমার স্বামী রহিমকে পাওয়া গেল না। বাড়ির লোকজনকে স্বাভাবিক মনে হলো। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। পরিচয় পেয়ে বাড়ির লোকজন জানালেন, তিনি কবরস্থানে গেছেন।

সে সময় কথা প্রসঙ্গে রহিমের বড় ভাবি বাবলি আক্তার বলেন, ‘নাসিমা নরম স্বভাবের ছিল। কারও সাথে ওর ঝগড়া ছিল না। নাসিমা মনে করছিল তার স্বামী রহিম গরুগুলো আনলেই বিক্রি করে খায়ে নিয়ে। গরু আনবার জন্য রহিম বের হওয়ায় নাসিমা এমন কাজ করেছে।’

রহিমদের বাড়ি থেকে তীরনই নদী প্রায় ৬০০ মিটার দূরে। সেই নদের ধারের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে নাসিমার ছেলে শাওন আর সাফায়েতকে। সেখানেও রহিমকে পাওয়া না গেলেও তাঁর বাবা শামসুল হককে পাওয়া গেল। তিনি তাঁর আরেক ছেলে জাহাঙ্গীরকে নিয়ে নাতিদের কবরের বেড়া তৈরি করছিলেন। সে সময় শামসুল বললেন, ‘বাড়িত তো কোনো ঝামেলা ছিল না। নাতি ২ টাকে নদী থেকে বাঁচাতে গিয়ে বউমা নিজেও ডুবে মারা যায়।’

তাহলে সবার হাত বাঁধা ছিল কেন ? এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারলেন না তিনি।

তবে গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান , ‘এলাকায় জুয়ার আসর আর নেশার আড্ডা বসে। জুয়ার আসরে রহিমকে দেখা যেত। তবে সে নেশা করত কি না, জানা নেই। গরু বিক্রি করে রহিম হয়তো জুয়ার টাকা জোগাড় করতে চাইছিল। আর সেটা মানতে পারেনি নাসিমা। এই জুয়ার জন্যই একটি পরিবারের তিনটি জীবন শেষ হয়ে গেল।’

রাণীশংকৈল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গুলফামুল ইসলাম মন্ডল জানান, বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সকালে মা ও দুই সন্তানের লাশ পাওয়া য়ায় তীরনই নদীতে।
লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে আসল ঘটনা জানা যাবে। তখন পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে । এবিষয়ে সন্দেহ ধারনার পরিপেক্ষিতে কাউকে হয়রানি করা যাবেনা।

রাণীশংকৈল সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল ইসলাম জানান, গত মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় ওই নারী তার স্বামীর সঙ্গে রাগারাগী করে সন্তানদের নিয়ে নিখোঁজ হন। পরেরদিন বুধবার সকাল সাড়ে ৮টায় উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের কাশিডাঙ্গা গ্রামে তীরনই নদী থেকে দুই সন্তানসহ মায়ের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *